রাইড শেয়ারিং সেবায় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন
- মাহমুদুল হাসান
- ৩১ জুলাই ২০১৮, ০০:০০
কাজ শেষে মোহাম্মদপুরের বাসায় ফিরতে নিয়মিত ভোগান্তিতে পড়তে হয় ইমরান আনসারীকে। কারণ অফিস ছুটির সময়ে বাসে খুব ভিড় হয়। ট্যাক্সি-সিএনজিওয়ালাও সুযোগ বুঝে দ্বিগুণ ভাড়া চায়। এখন স্মার্টফোনে দুই-তিনটা সার্ভিসের অ্যাপ নামিয়ে নিয়েছেন। অ্যাপে অনুরোধ পাঠালেই গাড়ি চলে আসে। দরদামেরও ঝামেলা নেই। বর্তমানে ঢাকায় বেশ কিছু স্মার্টফোন অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা চালু হয়েছে। শুরুতে বেশ ভালোই চলছিল। তবে কয়েক মাস ধরেই যাত্রীদের ভোগান্তির খবর শোনা যাচ্ছে। গুগল মানচিত্র অনুসরণ করে যাত্রা শুরুর স্থানে উপস্থিত না হলে যাত্রীর কল ফিরিয়ে দেয়া, সংক্ষিপ্ত পথ পরিহার করে দীর্ঘ পথে যাত্রী পরিবহন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ছাড়াও নীতিমালার বেশির ভাগ শর্ত মানছে না এসব প্রতিষ্ঠান। গতকাল মগবাজার থেকে উবার-এ অ্যাপ ব্যবহার করে গাড়ি ডাকলে কাওরানবাজারে অবস্থানরত একজন চালক তা গ্রহণ করেন। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় পর গাড়ি না এলে ওই যাত্রী মোবাইলফোনে চালককে রাইড প্রত্যাহারের অনুরোধ করলেও চালক তা করেননি, গাড়িও নিয়ে আসেননি। পরে ওই যাত্রী বাধ্য হয়ে রাইড প্রত্যাহার করেন, এতে ওই যাত্রীর ৩০ টাকা জরিমানা হয়।
স্মার্টফোন ব্যবহার করে জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতাল, কর্মস্থল, রাতে বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে অ্যাপভিত্তিক গাড়িগুলো। কিন্তু কোনো কোনো চালক যাত্রীকে ওঠানোর স্থান থেকে দূরে অবস্থান করলেও কল গ্রহণ করছেন। যাত্রী তোলার জন্য পিকআপ পয়েন্টে না গিয়ে অন্য চালককে হস্তান্তর করছেন। তাতে যাত্রীর অপেক্ষা বাড়ছে। আবার কোনো কোনো চালক গুগল মানচিত্র দেখে যাত্রীর অবস্থানস্থলে উপস্থিত হতে পারছেন না।
রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ১০টি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে নিবন্ধনের আবেদন করলেও তাদের নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে না। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয় থেকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিএ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে, নিবন্ধন পেতে হলে আবেদনকারী এসব প্রতিষ্ঠানকে সব শর্ত পূরণ করার নির্দেশ দেবে সরকার।
মোটরসাইকেলে যাত্রীবেশী অপরাধীদের পরিবহন ছাড়াও নানাভাবে যাত্রী হয়রানি করছে ‘পাঠাও’সহ মোটরসাইকেলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ‘পাঠাও’-এর মোটরসাইকেল চালকদের অনেকের লাইসেন্স নেই। পরিবহনের সময় যাত্রীকে হেলমেট দেয়া হয় না। অন্য দিকে, মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনের কারণে রাজধানীতে দুর্ঘটনা বেড়েছে। এ কারণে সরকার জনস্বার্থে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন সেবা বন্ধ করে দিতে পারে বলে জানিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিএ।
বর্তমানে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘উবার’, ‘ডাটা ভক্সেল লিমিটেড’ ছাড়াও দেশীয় প্রতিষ্ঠান ‘পাঠাও’, ‘সহজ’, ‘রাইডার’, ‘আকাশ টেকনোলজি’, ‘রিং টেকনোলজি’সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন সেবা দিচ্ছে। শুরুর দিকে কোনো নীতিমালা না থাকায় বিআরটিএ এসব সেবাকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। পরে এসব সেবা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে গত বছর জুলাই মাসে রাইড শেয়ারিং নীতিমালা চূড়ান্ত করে সরকার। প্রণীত নীতিমালা অনুসারে, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবেদন করে নিবন্ধিত হতে হবে। এ পর্যন্ত বিআরটিএ-তে ১০টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। রাজধানীর এলেনবাড়ির বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ে এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এ জন্য গঠন করা হয়েছে ‘রাইড শেয়ারিং সেল’ নামের একটি বিশেষ সেল।
বিআরটিএ’র রাইড শেয়ারিং সেলের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, উবার, পাঠাওসহ রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলো মনিটরিংয়ের জন্য বিআরটিএ’র কাছে ‘অনলাইন অ্যাকসেস’ ও ‘পাসওয়ার্ড’ দেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেবাদানকারী এ ১০টি প্রতিষ্ঠান এখনো তা করেনি। অ্যাপগুলোর সার্ভারসহ সব কার্যক্রম দেশে থাকতে হবে, এ শর্তও মানা হচ্ছে না। গাড়িচালকের তথ্যাদি ও যাত্রীর জিপিএস লোকেশন ন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক (৯৯৯) যাতে দেখতে পারে, তার ব্যবস্থা রাখার শর্ত দেয়া হলেও মানা হচ্ছে না। শুধু ৯৯৯ নম্বরে ফোন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, নীতিমালায় যেসব শর্ত রয়েছে তা না মানায় এসব প্রতিষ্ঠানকে পরিবহন সেবা দেয়ার অনুমতি বা নিবন্ধন ও লাইসেন্স দেয়া যাচ্ছে না। আমরা এসব প্রতিষ্ঠানকে জরুরি ভিত্তিতে চিঠি দেবো। কোন প্রতিষ্ঠান কোন কোন শর্ত পূরণ করছে না, তা জানিয়ে দেয়া হবে।
ঢাকায় ২০১৬ সালের শুরুতে প্রথমবারের মতো অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা শুরু করে আমেরিকাভিত্তিক ডাটা ভক্সেল ইনকরপোরেটের সহযোগিতায় ডাটা ভক্সেল লিমিটেড। ঢাকায় এটি অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল সেবা দিচ্ছে স্যাম অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে। ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর অ্যাপভিত্তিক যাত্রী পরিবহনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কম্পানি উবার ঢাকায় পরিবহনসেবা চালু করে। একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর পাঠাও শুরু করে মোটরসাইকেল পরিবহন সেবা। অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা দিচ্ছে ‘সহজ রাইডস’, ‘ও ভাই’সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে প্রায় ৭০ শতাংশ অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা দিচ্ছে উবার ও পাঠাও। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন নগরীর তুলনায় ঢাকায় উবার গাড়ির ব্যবহার শীর্ষে। সেবা চালুর পর সাত মাসের ব্যবধানে আট গুণ গাড়ি বেড়েছে উবার সেবায়। প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকায় গণপরিবহন সঙ্কট তীব্র। এ সঙ্কটের সুযোগে অ্যাপনির্ভর যাত্রী পরিবহনে যুক্ত হচ্ছে অলস পড়ে থাকা ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের পেশাজীবীর অলস পড়ে থাকা গাড়ি যাত্রী পরিবহন করছে ভাড়ায়। এটিকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল কেনার হিড়িক পড়েছে ঢাকায়। বিশেষ করে পুরনো প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের বাজার এখন চাঙা। অনলাইনেও এ ধরনের গাড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রচুর।
উবার এর আন্তঃনগর রাইড শেয়ারিং সার্ভিস
অন ডিম্যান্ড রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবার ঢাকা থেকে চালু করেছে আন্তঃনগর রাইড শেয়ারিং সার্ভিস। গত ২৬ জুলাই থেকে এই সার্ভিস গ্রহণ করতে পারছেন উবার যাত্রীরা। এখন ঢাকা থেকে গাজীপুর অথবা সাভার থেকে ঘুরে আসতে পারবেন উবারের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২২ টাকা এবং অপেক্ষমাণ থাকলে চার্জ ধরা হবে প্রতি মিনিটে ৩ টাকা। রাইডারদের চলাচলের সুবিধার্থে এখন গাজীপুর ও সাভারে নিয়মিত চলাচল করবে উবার।
ঢাকার আশপাশে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে যাওয়ার জন্য যারা সহজ এবং আরামদায়ক উপায় খুঁজছিলেন তাদের জন্য এই আন্তঃনগর সার্ভিসটি অত্যন্ত উপযোগী। রাইডাররা উবার ইন্টারসিটি ব্যবহার করে যেতে পারেন ব্যবসায়িক কাজ করতে অথবা শহরের বাইরে অবস্থিত ফ্যাক্টরি ভিজিটে কিংবা বন্ধুরা মিলে ঘুরে আসতে পারেন গ্রামের বাড়ি থেকে।
উবার ইন্টারসিটি ব্যবহার করতে চাইলে উবার অ্যাপ খুলে আপনার পছন্দমতো গন্তব্যস্থল (সাভার অথবা গাজীপুর) সেট করুন। অ্যাপে ভেসে উঠবে উবার ইন্টারসিটি অপশন। বুকিং কনফার্ম করলেই উবারের গাড়ি চলে আসবে। অ্যাপ আপনাকে যাত্রার সম্ভাব্য ভাড়া জানাবে। মূল ভাড়া নির্ধারিত হবে ট্রিপের ভ্রমণ দূরত্ব ও সময় অনুযায়ী। ওয়ানওয়ে ট্রিপের ক্ষেত্রে যদি ট্রিপটি ঢাকার সার্ভিস এরিয়ার বাইরে শেষ হয় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরতি ভাড়া যোগ হয়ে যাবে। ফিরতি ভাড়া সাভার অথবা গাজীপুরে ভ্রমণকৃত দূরত্ব অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। রাউন্ড ট্রিপের ক্ষেত্রে পুরো ট্রিপের দূরত্ব এবং অতিবাহিত সময় অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারিত হবে।